বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবায় সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সরকারি খাতে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা এবং ব্যষ্টিক এবং সামষ্টিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ব্যাপারে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। মন্ত্রণালয়ের অধীনে চারটি অধিদপ্তর যথাক্রমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, নার্সিং সেবা পরিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে থাকে।
স্বাধীনতার পর হতে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সেবার উপর প্রভূত কাজ করেছে। সরকার সকল জনগণ বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করার লক্ষে স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ পরিবার পরিকল্পনার বর্তমান অবস্থা বিশেষ করে নারী, শিশু ও প্রবীণদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং শারীরিক, সামাজিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার ক্ষেত্রে টেকসই উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত (এইচএনপি) সেক্টরের মূল লক্ষ্য। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি, জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নীতি এবং জাতীয় জনসংখ্যা নীতি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
স্বাস্থ, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবায় গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রে এনজিও সমূহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তারা মূলত: পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য অধিক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। সাম্প্রতিককালে এনজিওসমূহ তাদের সেবার পরিধি বাড়িয়েছে এবং শহরে প্রাথমিক সেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন কাজ করছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত পুন:গঠনের ক্ষেত্রে ১৯৮২ সালে প্রণীত ঔষধ নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষতিকর, মূল্যহীন ও অপ্রয়োজনীয় ঔষধ বাজার থেকে অপসারণ করা এবং স্বাস্থ্য সেবার সকল স্তরে প্রয়োজনীয় ঔষধ ন্যায্য মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষধ নীতি সাফল্যজনকভাবে রূপায়নের ফলে বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিকাল খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) সমূহ অর্জনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কিছু সূচক যেমন: শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, শিশু ও মায়েদের টীকা দেয়া, ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতি দূরীকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসাধারণ অর্জন সাধিত হয়েছে। অন্যান্য সুচকসমূহে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকায় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমন্বিত প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে।
শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে “জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১”। তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৯টি(১) কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২টি(২) উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপতালগুলোতে ২ হাজার শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯০ সালে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৪৯ থেকে নেমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫৩তে(৩)। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ১২টি(৪) মেডিকেল কলেজ, নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৪৭ হাজারেও বেশি জনশক্তি।
পুষ্টি, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্য—এই তিন খাতে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে। ১৩৩টি দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘সোশাল প্রোগ্রেস ইমপারেটিভ’
প্রতিষ্ঠানটি ‘সোশ্যাল প্রোগ্রেস রিপোর্টে’ জানায়, তাদের জরিপে মোট ১২টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে তিনটি বাদে ৯টিতে ভালো করতে না পারায় ৫৭.৭৩ পয়েন্ট নিয়ে ‘স্বল্প সামাজিক অগ্রগতির দেশের’ তালিকায় ১০১তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাস্থ্যখাতে সরকারের সাফল্যে আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। তিনি স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রগতির এ ধারা অব্যাহত রাখতে নিরন্তর গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে আরও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে অবদান রাখবে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, বাংলাদেশে নারী-পুরুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭১.৮ বছর।
সংসদে সরকারি দলের সদস্য এম. আবদুল লতিফের এক প্রশ্নের জবাবে আরো বলেন, ‘২০০৫-২০০৬ সালে গড় আয়ু ছিল ৬৫ বছর। বর্তমানে গড় আয়ু ৭১.৮ বছর। এর মধ্যে মহিলাদের ৭৩.১ বছর এবং পুরুষের ৭০.৬ বছর। ’
বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ওষুধশিল্প: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বাংলাদেশে তৈরী হচ্ছে বিশ্বমানের ওষুধ।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশর মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭০ বছরের বেশি হয়েছে। এতে ওষুধশিল্পের অবদান আছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য খাতে একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। এর পেছনেও ওষুধশিল্পের অবদান রয়েছে।
সমিতির নেতারা বলেন, দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিশ্বমানের ওষুধ উৎপাদন করছে। চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ তৈরি করছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্বমানের ওষুধ এত কম দামে আর কোথাও পাওয়া যায় না।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ডেভিড ন্যাবারো বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের সাম্প্রতিক অর্জন বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই দৃষ্টান্তস্বরূপ।
তিনি ম্যালেরিয়া নির্মূল, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, হৃদরোগ, নারীদের ক্যান্সার প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত কর্মসূচির প্রশংসা করেন। তিনি বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের অগ্রগতিতেও সন্তোষ প্রকাশ করেন।
স্পেনের সিমাগো রিসার্চ গ্রুপ পরিচালিত জরিপে বিশ্বের সকল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৬৪০তম হিসেবে স্থান পেয়েছে বিএসএমএমইউ।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রেক্ষিত: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বিএসএমএমইউ ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান এ তথ্য জানান।
পোড়া রোগীকে আধুনিক চিকিত্সা সেবা দিতে ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’র নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যেই এর নির্মাণ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
২০০৬ সালের ৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর চাঁনখারপুলে দেশের প্রথম এই বার্ন ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এক দশমিক ৭ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন ১৭ তলা এই হাসপাতাল ভবনটিতে ৫শ শয্যা বিশিষ্ট বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটসহ আধুনিক চিকিত্সা পদ্ধতির সব রকমের সুযোগ-সুবিধার সন্নিবেশ করা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে অটিজম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অটিজম চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখায় তাকে অটিজম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ড. পুনম ক্ষেত্রপাল বলেন, সায়মা হোসেন নজীরবিহীন উদ্যোগ ও তার ত্যাগের ফলে অটিজম সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের রোগ সম্পর্কে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন।
দেশের ওষুধের চাহিদা পূরণ করে ইউরোপের ২৬টি দেশসহ বিশ্বের ১২৭টি রাষ্ট্রে ওষুধ রফতানি করছে বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
যেসব কোম্পানির ওষুধের চাহিদা রয়েছে এগুলোর মধ্যে বেক্সিমকো ফার্মা, স্কয়ার ফার্মা, নোভারটিস লিমিটেড, টেকনো ড্রাগস, ইনসেপ্টা ফার্মা, রেনেটা লিমিটেড, এরিস্টো ফার্মা, অপসোনিন, বীকন ফার্মা, ওরিয়ন ফার্মা, এসিআই লিমিটেড, পপুলার ফার্মা, ইবনে সিনা, রেডিয়ান্ট, নভো হেলথ কেয়ার উল্লেখযোগ্য।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মেডিকেল জার্নাল ল্যান্সেটে প্রকাশিত এক গবেষণার মতে, স্বাস্থ্যসেবাখাতে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে ভারত। এতে বলা হয়, বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ভারতের অবস্থান ১৫৪তম। অথচ বাংলাদেশ ৫২তম অবস্থানে রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরেও স্বাস্থ্যসেবায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভারত ব্যর্থ হয়েছে। গত ২৫ বছরে আশানুরূপ স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারেনি দেশটি। চীন, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের চেয়েও ভারতের অবস্থান নিচের দিকে।
২০০৫ এর তুলনায় ২০১৫ সালে ডায়রিয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী শিশু মৃত্যুহার এক-তৃতীয়াংশ কমছে। ল্যানসেটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিশুদ্ধ খাবার পানি প্রাপ্তির কারণে এ হার কমেছে। তবে এখনও দুর্বল ও অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যুহার ২০ শতাংশের বেশি কমলেও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার কমছে ধীরগতিতে। শিশুদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার কমেছে ৩৪ শতাংশ। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে এ হার কমেছে ১০ শতাংশের কিছু বেশি।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS